শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৪ অপরাহ্ন
আবেদ হোসাইন, কালের খবর :
প্রযুক্তির উন্নত পরশ পেয়ে সভ্যতা হয়ে উঠেছে উন্নত থেকে উন্নতর, যোগাযোগমাধ্যমে ঘটেছে এক অবিস্মরণীয় বিপ্লব। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পঞ্চাশ বছর আগে বুঝতে পেরে লিখেছিলেন” বিশ্ব জগত দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে”। ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, আকাশ, ডিসলাইন, ভিডিও প্রভৃতির দরুন পৃথিবী এখন মানুষের হাতের মুঠোয়।
খুবই কম বাজেটে সব থেকে বেশি সুবিধা দিতে পারে মোবাইল ফোন, যার মূল্যটা সবার সাধ্যের মধ্যেই থাকে। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্রাউজিং, চ্যাটিং, অডিও, ভিডিও, গেমিংসহ প্রায় সকল প্রকার সুবিধার কারণে তরুণ-তরুণীদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অভিভাবকরা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছে এই মোবাইল নামক যন্ত্র, আর সন্তানরা এই ছোট্ট যন্ত্রের অপব্যবহারে ধ্বংস করে ফেলেছে নিজেদের নৈতিকতা এবং হয়ে উঠছে বেপরোয়া।
গবেষণায় দেখা গেছে বয়ঃসন্ধিকালে তরুণ-তরুণীরা প্রেম নামক প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছে। তবে যুবসমাজ ধ্বংসের সব থেকে ভয়ঙ্কর ফাঁদ হলো পর্নোগ্রাফি। ১৪-২২ বছরের কিশোর-কিশোরী বা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ জড়িয়ে পড়ছে ব্লু ফিল্মের আসক্তিতে। ইন্টারনেটের সুবাদে এবং বিভিন্ন অলিতে-গলিতে গড়ে ওঠা মোবাইল সার্ভিসের দোকান থেকে মেমোরিতে গান লোড করার নামে খুবই সহজে এবং অল্প টাকায় লোড করে নিচ্ছে এসব অশ্লীল ভিডিও। আর এসব নগ্ন ভিডিও একসঙ্গে দল বেঁধে দেখছে । ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ধর্ষণ।
২০১৭ সালে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামক এক সংস্থার জরিপে দেখা গেছে অষ্টম-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়াদের মধ্যে ৭৭ ভাগ শিক্ষার্থী পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।অন্য একটা জরিপের ফলোআপে দেখা যায়, নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখেন ৯০ ভাগ। এসব কাজ করতে গিয়ে যেমন কথা বলা, মেমোরি লোড দেওয়া, অথবা ডাটা প্যাক কেনার টাকা জোগাতে তরুণ প্রজন্ম পা বাড়াচ্ছে অন্ধকার পথে। ফলে খুব অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে যৌন চাহিদা এবং বাড়ছে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইল, অপহরণসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ।
বর্তমান সময়ে আরেকটি অভিশাপ তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, পাবজি-ফ্রি ফায়ার, ফেসবুক, ইন্টারনেট, মেসেঞ্জার, টিকটকেই এখন তাদের ব্যস্ত সময় কাটে। বিভিন্ন দোকান, মোড়ে ও শহরের অলি-গলিতে ব্রডব্যান্ড লাইন, ফ্রি ওয়াই-ফাই, বিভিন্ন ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছাত্র ও যুবসম্প্রদায়।
অন্যদিকে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতায় ঝুঁকে পড়ছে তরুণ সমাজ। রাতারাতি জনপ্রিয় হতে টিকটক, লাইকি বেছে নিচ্ছে অনেকেই। টিকটককে কেন্দ্র করে সংসার ভাঙছে, পরোকিয়া,আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ, এমনকি ঘটেছে হত্যাকাণ্ডও।
তরুণ বয়সে যেখানে আত্মবিশ্বাস, সুচিন্তা, নৈতিকতার মনমানসিকতা গড়ে তোলা দরকার, সেখানে এসব পর্নোগ্রাফি, ইন্টারনেট, গেমিং, টিকটক আসক্তির মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে যুবসমাজ, পড়াশোনা ও সুন্দর ক্যারিয়ার থেকে বিচ্যুত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে মাদকসেবীদের দলে, বিকৃত যৌনাচার চর্চা, সামাজিক লাজলজ্জা পরিহার করে তরুণ-তরুণীরা অবাধ মেলামেশার উগ্র আধুনিকতায় মিশে দূষিত করে তুলেছে এই সুশীল সমাজটাকে। অতিরঞ্জিত আধুনিকতা ও কু-সংস্কৃতির চক্রে পড়ে রাত-বিরাতে জনসম্মুখ কিংবা নাইটক্লাবে তারা অবাধে মেলামেশাটাকে বৈধ মনে করছে।
চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে এসব আসক্তির কারণে তরুণরা শারীরিক ও মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, একপর্যায়ে অতি আক্রমণাত্মক, বদমেজাজি ও খিটখিটে করে তোলে। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষকদের সঙ্গে তৈরি হয় দূরত্ব, হতাশায় ডুবে গিয়ে মেধাশূন্য হয়ে পড়ে, তারুণ্যসম্পদ একপর্যায়ে হয়ে ওঠে হুমকি স্বরূপ। আধুনিকতার নামে প্রযুক্তির অপব্যবহার না করে, ধর্মীয় দিক গুলোর প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পারলেই মিলবে মুক্তির মঞ্জিল।